উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ বিহার নওগাঁ জেলার বাদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। শান্তাহার-পার্বতীপুর রেল লাইনের জামালগঞ্জ স্টেশন হতে প্রায় ৩ মাইল পশ্চিমে এই বিহারটি দেখতে পাবেন। ৮০০-৯০০ সালে দ্বিতীয় পালরাজা ধর্মপাল এই বিহারটি নির্মাণ করেন। এটি একটি মহাবিহার। বিহারটির নির্মাণকালীন নাম সোমপুর মহাবিহার। বিহারটি উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির ও স্তূপ। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিহারগুলোর মধ্যে একটি। বিহারটি দুর্গের ন্যায় নির্মিত হয়েছিল। বৃহৎ এই স্থাপত্য কীর্তিটিতে ১৭৭টি বৌদ্ধ ভিক্ষুর কক্ষ, নিবেদন স্তূপ, ছোট ছোট মন্দির, একটি কেন্দ্রীয় মন্দির ছিল। ২৭ একর জমির ওপর এ বিহারটি নির্মিত।
বিহারের মধ্যে বিশাল আঙ্গিনার মধ্যে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দিরটি। এটি দেখতে অনেকটা ক্রুশের মত। মন্দিরের দেয়াল ইট ও কাঁদা দিয়ে নির্মিত। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০৮ মিটার এবং প্রস্থে প্রায় ৯৫ মিটার লম্বা। মন্দিরের উপরের অংশ এখন আর টিকে নেই। বর্তমানে মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট। এই কেন্দ্রীয় মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। মন্দিরের গায়ে লাগানো পোড়ামাটির চিত্রফলকের সংখ্যা প্রায় ২০০০। তবে পূর্বে আরও বেশি ছিল। এই বিহারটির প্রধান আকর্ষণ পালযুগে নির্মিত এইসকল পোড়ামাটির ফলকচিত্র।
বিহারের সীমানা দেয়াল বরাবর ভিতরের দিকে সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল। এগুলো ভিক্ষুদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ। কক্ষগুলোর সীমানা দেয়াল ছিল প্রায় ১৬ ফুট প্রশস্ত। এবং দেয়ালের ভিতরের সারিবদ্ধ কক্ষগুলোর প্রত্যেকটি ছিল দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৪ ফুট এবং প্রস্থে ১৩ ফুট। কক্ষগুলোর সামনে বারান্দা ছিল। বিহারটির প্রধান প্রবেশপথ ছিল উত্তরদিকে।
এ প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত লিখিত নিদর্শনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন যেটি পাওয়া গেছে সেটি ৪৭৯ সালের একটি তাম্রশাসন। মন্দিরের বাহিরের দেয়ালের পোড়ামাটির ফলকচিত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফলকচিত্রে বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত চিত্র ছাড়াও লোকায়েত শিল্পের নিদর্শনও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তৎকালীন সমাজের সাধারন মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা ও দৈনন্দিন কাজকর্ম ইত্যাদি এই লোকায়েত শিল্পে তুলে ধরা হয়েছে। পোড়ামাটির ফলকে জৈন, বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের নানা দেবদেবীর চিত্র সুন্দর ও নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লোকায়েত শিল্পের অন্যান্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, দণ্ড হাতে দণ্ডায়মান পুরুষ, তলোয়ার হাতে চলমান ভঙ্গিতে যোদ্ধা, শাড়ি পরিহিত নারী, নৃত্যরত নারী, শিশুসহ নারী, উটের পিঠে মানব, অলঙ্কৃত নারী, ব্যায়ামরত শারীরিক কসরত, নারী ও পুরুষ যোদ্ধা, রথ আরোহী তীরন্দাজ, পথিক, সন্ন্যাসী, পূজারী, লাঙ্গল কাঁধে কৃষক, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ নর-নারী সমাজের বিভিন্ন বাস্তবচিত্র। জীব জগতের প্রাণীর মধ্যে টেরাকোটায় স্থান পেয়েছে সাপ ভক্ষণরত রাজহাঁস, ফণা তোলা সাপের মাথায় মণি, ভাল্লুক ও চিতা বাঘের লড়াই, দুই মাথাযুক্ত সাপ, পদ্মকলি ভক্ষণরত রাজহাঁস, পদ্মকলি ভক্ষণরত ময়ূর, কুকুর, পেখম মেলা ময়ূর, শামুক, লাফ দায়া ভঙ্গিমায় হরিণ, বাঘ, মহিষ, মাছ, বানর, হাতি, সিংহ, শূকর, কাছিম, ঘোড়া, বেজী, খরগোশ, ষাঁড়, গাধা, পাতিহাঁস, ঈগল, মোরগ-মুরগী ইত্যাদি। উদ্ভিদের মধ্যে পদ্ম, কলাগাছ, লতাপাতা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে পোড়ামাটির বিভিন্ন চিত্রফলকে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (ঐতিহ্য নং ৩২২) হিসেবে ঘোষণা করে।
বিহারের পূর্ব-দক্ষিন কোণে প্রাচীরের বাহিরে একটি বাঁধানো ঘাট দেখতে পাওয়া যাবে, এটি সন্ধ্যাবতীর ঘাট নামে পরিচিত।
Last Updated Date of This Artical : 0000-00-00